হাম্দ ও ছানার পর :
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِی السِّلْمِ كَآفَّةً
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ قُوْلُوْا قَوْلًا سَدِیْدًا یُّصْلِحْ لَكُمْ اَعْمَالَكُمْ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ ؕوَ مَنْ یُّطِعِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِیْمًا.
একটি মাসআলা আমরা সবাই শুনেছি, দ্বীনী ইল্ম হাছিল করা ফরয। হয়ত অনেকে এভাবে শুনেছি যে, ফরযের দুটো স্তর। ফরযে আইন, ফরযে কেফায়া। কিছু পরিমাণ ইলম ফরযে আইন, কিছু পরিমাণ ইলম ফরযে কেফায়াহ। ফরযে আইন ইলম বলতে বোঝায়, যে পরিমাণ ইলম সবার জন্য শেখা ফরয। আর ফরযে কেফায়া ইলম হল সেটা দ্বীনের ইলম, যা সবার জন্য শেখা ফরয নয়, তবে কিছুসংখ্যক আলেম এমন থাকা জরুরি যারা ফিকহ ও দলীল-আদিল্লা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। যাতে কারো প্রয়োজন হলে তাঁদের কাছ থেকে শিখতে পারে ও জানতে পারে।
আজকে আমরা ফরযে আইন ইলম সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
প্রথমেই ঈমান, ইসলাম শিখতে হবে। এই শেখাটার প্রথম স্তর হল ফরযে আইন ইলম। আপনি যদি বলেন ঈমান শিখব, ইসলাম শিখব- এর মানেই হল যতটুকু ইলম ফরযে আইন ততটুকু শিখতে হবে। শেখার দুটি স্তর আছে। এক হচ্ছে, জ্ঞান অর্জন করা, আরেকটা হল প্রায়োগিক শিক্ষা। যা শিখবেন ওটার প্রয়োগ করার অনুশীলন করতে হবে। শুধু জ্ঞান অর্জন করলাম তাহলে এই শেখা পরিপূর্ণ হল না। ফরযে আইন যতটুকু ইলম, এর মধ্যেও দুটি স্তর আছে। একটা হল, জ্ঞান অর্জন আরেকটা হল, সেটার প্রায়োগিক শিক্ষা-অনুশীলন। তাহলে ফরয আদায় হবে। অন্যথায় ফরয আদায় হবে না। এই যে একটা শব্দ আমরা বলি, ‘ঈমান শেখা’ খুব দামী, কঠিন এবং গভীর একটা শব্দ। তো ঈমান শেখা বলতে গেলেই আমাকে ফরযে আইন ইলম শিখতে হবে। ফরযে আইন ইলম শেখার ব্যবস্থা না করে যতই ঈমান শেখার কথা বলি, ঈমান শেখা হবে না। এমনকি ফরযে আইনের উভয় পদ্ধতিতে; জ্ঞান অর্জন আর প্রায়োগিক অনুশীলন -এই উভয় স্তরের ফরযে আইন পরিমাণ ইলমের উপর মেহনত করলে ঈমান শেখা হবে, ইসলাম শেখা হবে।
এখন বুঝতে হবে, ফরয আইন ইলমের অধ্যায়গুলো কী কী।
ফরযে আইন ইলমের দুটো স্তর। জ্ঞান অর্জন ও প্রায়োগিক অনুশীলন। এখন বলছি ফরযে আইন ইলম দুই প্রকার। প্রথম প্রকার ইলম শুরু হয় ঈমান আনার পরেই। যে আল্লাহর মেহেরবানীতে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে সে শুরু থেকেই ঈমানওয়ালা, ইসলাম ওয়ালা। তো ঈমান আনার পর থেকে, ইসলাম সম্পর্কে বোধ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই এই অংশের ইলম অর্জন শুরু করতে হবে। এক দিনের এক সপ্তাহের এক মাসে আমি শিখে শেষ করতে পারব না। ঠিক আছে। এক সপ্তাহে সব শিখে ফেল- শরীয়ত এটা বলে না। কিন্তু শিখতে থাকতে হবে। বাদ দেওয়া যাবে না। এমনিই তো আমরা ছুটি পাই। যেমন, আজকের দিন পুরা ইলমের জন্য আমরা ওয়াক্ফ করেছি, কিন্তু এর মধ্যেও কি ছুটি পাইনি আমরা? ছুটি দিতে হবে। ছুটি না দিলে আমরা লাগাতার কীভাবে কাজ করব? আমরা রোযা রাখি। তাতে কি ছুটি নেই? প্রথম ছুটি তো ইফতার। ইফতারের পর থেকে আবার সেহরীর শেষ পর্যন্ত ছুটি। নামায ফরযে আইন। কিন্তু ছুটি আছে। ফজরের নামাযের পর থেকে লম্বা ছুটি যোহর পর্যন্ত। যোহরের পর থেকে আছর পর্যন্ত মোটামুটি লম্বা ছুটি। আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ছুটি। মাগরিবের পর থেকে ইশা পর্যন্ত। আমাদের দেশে তো ইশা আগে আগে পড়ে, এজন্য কম ছুটি। ইশা আরো দেরীতে পড়লে আরো ছুটি। আর ইশার পর থেকে একেবারে ফজর পর্যন্ত ছুটি। আল্লাহ তাআলা কত আসান করেছেন। দ্বীন বুঝার, দ্বীন শেখার এবং দ্বীনের উপর চলার যদি কারো ইচ্ছা থাকে, নিয়ত থাকে তাহলে কি কঠিন? নিয়ত না থাকলে তো সহজ থেকে সহজ বিষয়ও কঠিন। যাই হোক, বলছিলাম দ্বীন শিখতে থাকতে হবে। দ্বীন শেখা বাদ দেওয়া যাবে না। মানে হল, আপনি ভুলে যেতে পারবেন না। এক সপ্তাহে একটু শিখলেন, তারপর আর খবর নেই, ভুলে গেছেন। আমাদের ফরয ইলমের যে অনেক বাকি আছে, তার খবর নেই। ভুলেই গেছে। এটা কি জায়েয হবে? জায়েয হবে না। চলতে থাকতে হবে। ছুটি নিতে পারব, কিন্তু একেবারে ভুলে যেতে পারব না। এক সপ্তাহ একটু শিখলাম তারপর তিন দিনের ছুটি বা আরো এক সপ্তাহের ছুটি, ঠিক আছে, এক সপ্তাহ পর আসুন। আরেকটু শিখুন। কিন্তু একদিন একটু শিখলাম, তারপর মাসকে মাস পার হয়ে গেল, বছরকে বছর পার হয়ে গেল, আর কোনো খবর নেই, এটা কি ছুটি নেওয়া হল, না ভুলে যাওয়া হল? ভুলে যাওয়া যাবে না। ফরযে আইন ইলমের যতক্ষণ একটা অংশও বাকি আছে, যেটা আমি শিখিনি, ততক্ষণ পর্যন্ত ভুলে যাওয়া যাবে না। চালিয়ে যেতে হবে। অবহেলা করতে পারবেন না। এটা হল এক প্রকার ফরয ইলম।
আরেক প্রকার, যখন যে কাজ তখন সেটা শেখা ফরয। দেরি করা যাবে না। আগের প্রকার তো বললাম, সেটা ছুটি নিয়ে নিয়ে শিখতে থাকেন। কিন্তু অবহেলা করে ভুলে যাওয়া যাবে না। আরেক প্রকার ফরযে আইন ইলম হল, যেটা নগদ দরকার সেটা নগদ শিখতে হবে। দেরি করা যাবে না। একজন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছে, ভালো কথা। কিন্তু ব্যবসার মধ্যে তো দু’প্রকার আছে, হালাল ও হারাম। আরেক প্রকার আছে হারাম ও হালালের মিশ্রণ। এখন আমাকে জানতে তো হবে যে, এটা হালাল, এটা হারাম, এটা সন্দেহযুক্ত। এমন কিছু যদি করি যাতে হালাল-হারাম মিশ্রিত- এটা করা যাবে না। কিছু ব্যবসা আছে যা আগাগোড়াই হারাম। কাজেই কোনটা হালাল, কোনটা হারাম তা জানতে হবে। আমি ব্যবসা শুরু করব এখন আর শিখব এক বছর পর, এক বছর শেখা ছাড়াই ব্যবসা চালাব, এটা হয় না।
ব্যবসার কিছু বিষয় আছে কৌশলগত। কিছু আছে ব্যবস্থাপনাগত। ব্যবস্থাপনাগত বিষয় আপনি অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর কাছে শেখেন বা কিছুদিন বড় ভাইয়ের দোকানে বসে তার কাছ থেকে শেখেন। কিন্তু হারাম-হালালের বিষয়গুলো আলেমের কাছ থেকে শিখতে হবে। ব্যবসা খুলে দিলেন কিন্তু ব্যবসার হারাম-হালাল জানলেন না, ফরযে আইন লংঘন হল। ব্যবসায় ঢুকেননি তাহলে ব্যবসার হালাল-হারাম সম্পর্কে আরো দেরিতে জানলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু যখন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন তখন আর দেরি করার সুযোগ নেই। ব্যবসা শুরু করবেন এই সপ্তাহে, ব্যবসার হালাল-হারাম জানবেন কি এক সপ্তাহ পর, একমাস পর? না এখনই। তো এটা হচ্ছে আরেক প্রকারের ফরযে আইন ইলম। মানে যা আমাকে এখনই জানতে হবে। দেরি করা যাবে না।
একজন হজ্বে যাওয়ার নিয়ত করেছে। তো হজ্বের পদ্ধতি শিখতে হবে না? এটা নগদ দরকার, দেরি করা যাবে না। হজ্বের ইহরাম বেঁধে ফেললাম, রওয়ানাও হয়ে গেলাম। কিন্তু খবর নেই যে, ইহরাম কাকে বলে। অনেকে মনে করে, সাদা দুটো কাপড় পরিধানের নামই ইহরাম। লোকে বলে ইহরাম বাঁধা। আর মনে করে কাপড় বাঁধাই হল ইহরাম বাঁধা। যেমন বলা হয় নামাযের নিয়ত বাঁধা। ওখানে কী বাঁধে? হাত বাঁধে। আসলে নিয়ত বাঁধা মানে নিয়ত করা। এই না যে, কোনো কিছু দিয়ে বেঁধে ফেলা। তো ইহরাম বাঁধার মানে হল, হজ্বের ইহরাম করা। কীভাবে তা করবে আর এর কারণে নতুন কী কী বিধান আসবে, এগুলো জানতে হবে। কিন্তু দেখা যায়, অনেকের এগুলো কিছুই জানা থাকে না।
একবার বিমানবন্দরে গেলাম একজনকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। হজ্বে যাচ্ছিলেন। ওখানে একজন জিজ্ঞাসা করল, এক বেচারা ইহরামের কাপড় লাগেজে দিয়ে দিয়েছে। লাগেজ চলে গেছে ভেতরে। সঙ্গে ছোট ব্যাগে ইহরামের কাপড় রাখেনি। বাড়ি থেকে ইহরাম বেঁধে যায়নি। এটা ঠিক যে ইহরাম বাড়ি থেকে বেঁধে না আসারও অবকাশ আছে। ইহরাম বাঁধার শেষ একটা জায়গা আছে। যে যে দেশ থেকেই মক্কা শরীফে আসুক। একটা শেষ সীমানা আছে। ওখানে এসে ইহরাম বাঁধতেই হবে। ইহরাম না বেঁধে ওই মীকাত অর্থাৎ ঐ জায়গা অতিক্রম করা যায় না। বিমান ঢাকা থেকে রওয়ানা হলে পাঁচ ঘণ্টা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মত সময় লাগে। জিদ্দা পৌঁছার আগেই ঐ জায়গাটা এসে যায়। তো এখন কেউ বাসা থেকে ইহরাম বাঁধল না, বিমান বন্দর থেকেও করল না, কিন্তু জেদ্দায় পৌঁছার ঘণ্টা খানিক আগে তার ইহরাম বাঁধতে হবে। নতুবা তার ঐ সীমানা অতিক্রম করতে হবে ইহরাম ছাড়া; এটা নাজায়েয। এমন হয়ে গেলে কী করতে হবে সে মাসআালাও আছে। তো চাইলে এই অবস্থাতেও ইহরাম বাঁধা যায়, নিয়ত করে লব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক… বললে ইহরাম হয়ে গেল। কিন্তু সে তো সাধারণ পোষাক পরে আছে। ইহরাম অবস্থায় পুরুষ এই সাধারণ পোষাক পরে থাকতে পারে না। এখন করবে কী? এটা কি নগদ মাসআলা হল না? এটাও শিখেনি, হজ্বে রওয়ানা করেছে। এখন কে বলবে মাসআলা? তো একজন মুফতী সাহেব ছিলেন, বলে দিয়েছেন মাসআলা- যে আপনি বিমানে বসে ঘণ্টা দুয়েক পর নিয়ত করে তালবিয়া পড়বেন। আপনার ইহরাম শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এই ২/৩ ঘণ্টা ইহরামের পরিপন্থী হালতে থাকবেন এটা ওযর। এখন করবেন কী, ভুল হয়ে গেছে। ইস্তেগফার পড়তে থাকবেন আর ওখানে গিয়ে কাপড় হাতে পাওয়ার পরপরই ইহরামের কাপড় পরে নিবেন। আর কয়েকঘণ্টা ইহরাম পরিপন্থী হালতে ছিলেন এর জন্য যে জরিমানা আসে তা আদায় করবেন।
তো ভালো যে, মুফতী সাহেবকে পেয়েছেন। না পেলে তিনি কী করতেন? অনেকে ইহরামের জন্য কাপড়কেই মূল মনে করে। কাজেই সে ভাবত যে, কাপড়ই যেহেতু নেই আমি আর কী করব? জিদ্দায় যাই, তারপর ইহরাম বাঁধব। অথচ ওটা করলে ডবল গুনাহ হত।
তো আমি বলছিলাম, যে ইলম আপনার এখন দরকার, সেটা আপনাকে এখনই শিখতে হবে। একেক জনের একেক যরুরত। যে ব্যবসায় নামবে তার ব্যবসারটা দরকার। যে হজ্বে যাচ্ছে তার হজ্বেরটা দরকার। এরকম একেক জনের একেক বিষয়ের ইলম দরকার।
একজন চাকরি নেবে, আগে কোথাও চাকরি করেনি। এই প্রথম চাকরি; তাকে চাকরির মাসায়েল জানতে হবে। আমি একজন চাকরিজীবি হিসেবে, একজন কর্মচারী বা কর্মকর্তা হিসেবে যেই স্তরের হই না কেন- আমার উপর তো কিছু দায়-দয়িত্ব আসে। কী কী দায়িত্ব আসে? সকাল এতটায় যেতে হবে, এতটায় ফিরতে হবে। অফিস সময়গুলো বলে দিল। এ সময়টা অফিসের দেওয়া সময়। এটা পালন না করলে শুধু কর্তা নারায হবে, মালিকপক্ষ নারায হবে, এইটুকু? না, এ সময়টা অফিসে না দিলে আল্লাহও নারায হবেন? এই বিষয়টা তো আমাকে জানতে হবে। যার যে পেশা সেই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট বিধান জানতে হবে।
একজন সেলুন খুলছে। এটা তার পেশা। কিন্তু কেউ কি সেলুন খোলার পর মুফতী সাহেবের কাছে যায় যে, হুযুর আমি একটি সেলুন খুলেছি, এটা আমার আয়ের উৎস। আমাকে এ সংক্রান্ত মাসায়েল বলুন? কারণ হুযুরের কাছে গেলে হুযুর বলবেন যে, কারো দাড়ি কামাতে পারবে না। মানুষ এসে ভীড় করুক দাড়ি কামানোর জন্য, তুমি পারবে না। দাড়ি কামালে তো টাকা দেয়, সেটা হালাল না হারাম, কী হুকুম? এগুলি জানতে গেলে তো অসুবিধা! একজন দোকানদার কত পণ্য-সামগ্রী তার দোকানে রাখে। কোনটা দোকানে রাখা ও বিক্রি করা জায়েয, কোনটা জায়েয নয়- মাসআলা জানতে হবে। জানতে আসলেই হয়ে যায়। আমি যে আয়াত পড়লাম-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِی السِّلْمِ كَآفَّةً
হে ঈমানদারগণ! (যারা ঈমান এনেছো), তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। -সূরা বাকারা (২) : ২০৮
পূর্ণ ইসলামকে বিশ্বাস কর। পূর্ণ ইসলামকে গ্রহণ কর। পূর্ণ ইসলামকে মান। গ্রহণ করতে, মানতেই যদি অসুবিধা তাহলে তো ঈমান হল না। আর যদি গ্রহণ করে, মানে কিন্তু আমল করতে গেলে ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যায়। বিভিন্ন কারণে করতে পারে না। নিজেকে অপরাধী মনে করে, তাহলে ঈমান আছে কিন্তু আমলের ত্রুটি। আর যদি গ্রহণই না করে এবং বলে নামায রোযার কথা হুযুররা বলে, ঠিক আছে, এখন দেখি আমার একটা সেলুন আছে, হুযুররা এটার উপরও কথা বলা শুরু করেছে, এটাও নাকি আমার হুযুুরদের কাছে শিখতে হবে? এটা তো শিখব ভালো নাপিতের কাছে। হুযুরদের কাছে এটা শেখার কী?
শুনুন, ভালো নাপিতের কাছে শিখবেন, কীভাবে কাঁচি ধরবেন, কীভাবে চালাবেন- এগুলো। এটা নাপিতের কাছে যাওয়া ছাড়া শেখা যাবে না। একটা কিসসা বলি। এক নাপিত বাদশার চুল-মোঁচ ঠিকঠাক করত। একদিন বাদশা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তো নাপিত এসে বাদশাকে ঘুমের মধ্যে রেখেই চুল কাটা শুরু করল। এবং যেভাবে করা দরকার করে দিল। ঘুম থেকে উঠে বাদশা আশ্চর্য হয়ে গেলেন, আরে! নাপিত এসেছিল? কীভাবে করল সে? আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, টেরই পেলাম না, ঘুমও ভাঙ্গল না! এ তো নাপিতদের বাদশা। হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. কিসসাটা বর্ণনা করেছেন। ঘটনা তো ঘটনাই্, সম্ভবত এটা বাস্তব ঘটনা হবে। তো বাদশা যখন সনদ দিলেন যে, ‘নাপিতদের বাদশা’, তো বাদশাহর কথা নাপিতের জন্য খুব সম্মানের বিষয়। কথাটা খুব মশহুর হয়ে গেল। এখন অন্যান্য নাপিতের স্ত্রীরা এসে এ নাপিতের বউকে, মোবারকবাদ জানাচ্ছে যে, বাদশা তোমার স্বামীকে ‘নাপিতের বাদশা’ বলেছেন। তখন এই নাপিত বা তার স্ত্রী মন্তব্য করল, বাদশা তো বাদশাই। কোন্ নাপিত তার পেশাতে বড়, এটা বাদশা বুঝবেন না, এটা তার বিষয় না। এই পেশার যারা গুরু তারা কেউ এই সনদ দিলে এর মূল্য ছিল। কিন্তু এই সনদ দিয়েছেন দেশের বাদশা। এটা তো তাঁর বিষয় নয়।
বুঝতে পেরেছেন? বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেব দা. বা. এই ঘটনা অনেক বলেন। আমরা বলি না যে, অমুক হুযুর অনেক বড় আলেম, অমুক হুযুর অনেক বড় বুযুর্গ। আমি কী বুঝি- তিনি অনেক বড় আলেম না ছোট আলেম। এটা তো আরেক আলেমই বুঝবেন। তো আমি বলছিলাম এই যে, এত পারদর্শিতা সে অর্জন করেছে যে, ঘুমন্ত অবস্থায় একজনের চুল-মোঁচ কেটে দিয়েছে, ঘুম ভাঙেনি, এটা কি ছোটখাট কোনো পা-িত্য? এটা কোনো হুযুরের কাছে শিখতে হবে? সেলুনওয়ালাদেরকে আমরা বলি না যে, এটা হুযুরের কাছে শিখতে আস। এটা তো নাপিতের কাছেই শিখতে হবে। হুযুুরের কাছে যা শিখতে হবে, তা হল, সেলুনের জন্য যদি সে দোকান ভাড়া নিয়ে থাকে সে ভাড়া সংক্রান্ত মাসআলা জেনে নিবে। একজন মহিলা এসে তার চুল ছোট করে দিতে বলল, এটা করা তার জন্য জায়েয হবে, নাকি হবে না- হুযুরের কাছে জানতে হবে। নাপিত হলো পুরুষ, এসেছে মহিলা; তাও আবার মাথার চুল ছোট করার জন্য?!
চুলের বিভিন্ন ঢং দেখবেন সেলুনে। বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন ঢং ভালো লাগে। এগুলোর অনেকগুলোই অনুত্তম। কিছু কিছু আছে, নাজায়েয। ঢালাওভাবে সবগুলোকে না জায়েয বলা যায় না। আমরা যেভাবে চুল রাখি, হয় বাবরী চুল আর না হয় ছোট করে সামনে পেছনে বরাবর করে রাখি। একেবারে স্বাভাবিক। এটা হল সুন্দর পদ্ধতি। এর ব্যতিক্রম হলে হারাম হবে- তাও বলছি না। কিন্তু ব্যতিক্রমের মধ্যে যা যা আছে, সবগুলো জায়েয ফ্যাশনে পড়ে না। কিছু না জায়েযও আছে, সেটা জানতে হবে। যে এমন ফ্যাশন করতে চায় তারও জানতে হবে আর যে এমন ফ্যাশন করে দেবে তারও জানতে হবে।
বিউটি পার্লার আছে না? ওখানে কী কী কর্মকা- হয়? কোনো পার্লারওয়ালা তো দারুল ইফতায় আসে না। ফরযে আইন লংঘন। আরে ভয় পাওয়ার কী আছে? তুমি মাসআলা জান। আমল যদি করতে নাই পার নিজেকে অপরাধী মনে কর। নিজেকে অপরাধী মনে করলেও তো গুনাহ কমল। কিন্তু না জায়েযকে জায়েয মনে করে করা? মানুষ জানতে ভয় পায়। জানতে ভয় পাওয়া ঠিক নয়। হালাল হারামের খোঁজ-খবর নেওয়া দরকার। আমলের মধ্যে যদি ত্রুটি হয়েও যায়, নিজেকে তো অন্তত অপরাধী মনে করব। এটুকু লাভ তো হল। কিন্তু যদি আমি না-ই জানি তাহলে তো হারামকে হালাল মনে করব। নাজায়েযকে জায়েয মনে করব। এটা তো আরো বড় সমস্যা। এজন্যই বললাম, যার যেটা পেশা, যার যেটা কর্মক্ষেত্র তাকে ঐ বিষয়ের ইলম অর্জন করতে হবে। তদ্রূপ যার যেই হক এখন তার উপর এসেছে- সে সম্পর্কে জানতে হবে।
বাবা হয়ে গেলাম কিন্তু কোনো মাসআলা জানারই যরুরত মনে করলাম না। একজন স্বামী হয়ে গেল, কোন মাথাব্যাথা নেই তার মাসআলা জানার ব্যাপারে। মেয়েকে যখন বিয়ে দেওয়া হল, স্ত্রী হিসেবে তার উপর কী কী মাসআলা আসছে জানার যরুরত মনে করা হল না। বাবা ইন্তেকাল করেছে, মীরাসের মাসআলা জানার যরুরত মনে করা হল না। এরকম কত ক্ষেত্র, কয়টা বলব? কয়েকটি উদাহরণ দিলাম। যে যে পেশায় থাকুক সে পেশা সংক্রান্ত শরীয়তের মাসআলা থাকবে। কেউ কৃষক; এ বিষয়ে কত মাসআলা। আবার কেউ আইনজিবী; তারা শুধু লয়ারদের কাছেই প্র্যাকটিস করতে যায় কিন্তু তাদের কম লোকই হয়ত হুযুরদের কাছে আসা জরুরি মনে করে। আমার যদি মজবুত মাধ্যম থাকত সব আইনজিবী-উকিলদের কানে এই আয়াতের পয়গাম পৌঁছে দিতাম-
وَ لَا تَكُنْ لِّلْخَآىِٕنِیْنَ خَصِیْمًا
আর তুমি খেয়ানতকারীদের পক্ষ অবলম্বন করো না। -সূরা নিসা (৪) : ১০৫
যদি উকিলরা এই বিধানটির উপর আমল করত তাহলে যেসব ক্ষেত্রে বাদি-বিবাদির এক পক্ষ নিশ্চিত জালিম, তার কি নিজের জন্য উকিল পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল?
আমি একটা ইবাদত শুরু করলাম, কীভাবে করব? যে কাজ আমি করতে চাই, সে কাজের ক্ষেত্রে কী কী বিধান আছে, জীবনের কোন্ অবস্থায় কী বিধান- আরবীতে এটাকে বলে ‘ইলমুল হাল’, মানে নগদ অবস্থায় তোমার কী বিধান জানা দরকার; কী বিধান তোমার উপর আরোপিত হচ্ছে, সে বিধান সম্পর্কে জানা ফরযে আইন।
নগদ ফরয। এটা ফরযে আইন ইলমের এক প্রকার। আরেক প্রকার যা এখনের বিষয় না, তখনের বিষয় না, সব সময়ের বিষয়। সেটা আস্তে আস্তে শিখে ফেলতে হবে। সেটা হল আকীদার বিষয়। এক নম্বরে আকীদা। এটা জানা ফরযে আইন। দ্বিতীয় নম্বর হল ফরযসমূহ; ইসলাম কী কী বিষয় ফরয করেছে। ফরযের তালিকা জানা থাকতে হবে। ইসলাম কী কী জিনিস হারাম করেছে, হারামের তালিকা জানতে হবে। তাহলে এক নম্বরে হল আকীদাতুল ইসলাম, যা মক্তবে পড়ে এসেছেন; ঈমানে মুজমাল-
آمَنْتُ بِاللهِ كَمَا هُوَ بأسمائه وَصِفَاتِه.
আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম, আল্লাহ তাঁর নামসমূহ ও গুণাবলীসহ যেভাবে আছেন। وَقَبِلْتُ جَمِيْعَ أَحْكَامِه وَأَرْكَانِه এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম আমি মেনে নিলাম। এটা হল সংক্ষিপ্ত। আরেকটু বিস্তারিত হল ঈমানে মুফাসসাল-
آمَنْتُ بِاللهِ، وملائكته، وَكُتُبِه، وَرَسُلِه، وَالْيَوْمِ الْاخِرِ، وَالْقَدْرِ خَيْرِه وَشَرِّه مِنَ اللهِ تَعَالى، وَالْبَعْثِ بَعْدَالْمَوْتِ.
এগুলো ইসলামের আকীদা। আমরা চাই যে মক্তবে উস্তাদযী আমাকে যে আকীদার শুধু নামগুলো শিখিয়েছেন, ব্যস ঐটুকু নিয়েই কবরে যেতে। আল্লাহর প্রতি ঈমান, ফেরেশতার প্রতি ঈমান, কিতাবের প্রতি ঈমান এগুলো তো শুধু শিরোনাম। এগুলোর অর্থ কী? কী অর্থ আল্লাহর প্রতি ঈমানের? এই যে বললাম كَمَا هُوَ بأسمائه وَصِفَاتِه ‘যেমন আল্লাহর নাম ও গুণাবলী’ সেভাবে আমি ঈমান আনলাম। কিন্তু সেই নাম ও গুণাবলী কী? মক্তবে তো তা বলা হয়নি। আর আপনি চাচ্ছেন এভাবেই কবরে চলে যেতে। এই আকীদার প্রত্যেকটি নামের অধীনে এর বিশ্লেষণ আছে। ঈমান বিল্লাহ কী? ১-২-৩-৪-৫ এগুলো সবকটা মিলে ঈমান বিল্লাহ। কুরআনের প্রতি ঈমান মানে কী? ১,২,৩,৪,৫ এই কতগুলো বিষয় নিয়ে কুআনের উপর ঈমান। বিস্তারিত আকীদা যদি অন্তরে থাকে তাহলে আল্লাহর প্রতি ঈমান হল, কুরআনের প্রতি ঈমান হল। ভাই বলুন দেখি আল্লাহর প্রতি ঈমান মানে কী? তা তো জানি না। তো আকীদার শুধু নামগুলোই মুখস্থ করে কি কবরে যেতে চাই? কুরআন ও হাদীসে প্রতিটির যে বিশ্লেষণ আছে তা কি জানতে হবে না? এটা হল ‘আকীদাতুল ইসলাম’।
ফরযে আইন ইলমের প্রথম বিষয় হল আকীদাতুল ইসলাম। দ্বিতীয় কথা ‘ফারায়েযুল ইসলাম’। কুরআন-হাদীসে আল্লাহ আমার উপর কী কী জিনিস ফরজ করেছেন, একজন মুসলিমের উপর কী কী জিনিস ফরয এগুলো জানতে হবে। তৃতীয়ত, ইসলাম তার অনুসারীদের উপর কী কী জিনিস হারাম করেছে? সগীরা গুনাহ, কবীরা গুনাহ সবই তো গুনাহ। হারাম, মাকরূহে তাহরীমী, মাকরূহে তানযীহী সবই তো বর্জনীয়। কিন্তু বর্জনীয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কী? হারাম এবং মাকরূহে তাহরীমী। এগুলোর তালিকা আমার জানা থাকতে হবে না? তা হল- আকীদাতুল ইসলাম, ফারায়েযুল ইসলাম, মাহারিমুল ইসলাম এই বিষয়গুলো।
আরেকটি শিরোনাম হচ্ছে ‘আদাবুল ইসলাম’-ইসলামের আদব। কোন্ ক্ষেত্রে কী আদব-কায়েদা ইসলাম জানিয়েছে এগুলো শিখে ফেলতে হবে। বলে, হুযুর আদব তো আর ফরয না। কোনো কোনো আদব আছে ফরযেরও দাদা। আদব পরিপন্থী কোনো কিছু করাকে কী বলে? বেয়াদবী বলে। সব বেয়াদবী কী জায়েয? কত বেয়াদবী আছে তো হারাম, কত বেয়াদবী আছে এর কারণে ঈমানই চলে যায়। তাহলে আদব শেখা কি মামুলী কথা, না গুরুত্বপূর্ণ কথা? ইসলামের আদবগুলো শিখতে হবে। কোন ক্ষেত্রে কী আদব শিখিয়েছে ইসলাম তা জানতে হবে। প্রয়োগের ক্ষেত্রে সব আদব রক্ষা করা সব সময় জরুরি নয়। ফরয নয়। কিন্তু আদব জানা থাকা, ইসলামের আদব জানা থাকা ফরয। সব আদব এক মাপের নয়। কিছু আদব আছে ফরয, কিছু আদব আছে মুস্তাহাব। মুস্তাহাব যেটা সেটাতো আর ফরয নয়। কিন্তু আপনার জানা তো থাকতে হবে যে ঐ আদব ফরয আর এই আদব মুস্তাহাব। মুস্তাহাবটা দৈনিক আমল না করলে না করলাম। যেমন জামা গায়ে দেওয়ার সময় ডান হাত আগে ঢুকানো এটা মুস্তাহাব। ভুলে বাম হাত আগে ঢুকে গেছে এতে ফরয বা ওয়াজিব লংঘন হয়নি। কিন্তু মুস্তাহাব লংঘন হয়েছে। কিন্তু সওয়াব আছে না এতে? ইচ্ছাকৃত আদব পরিপন্থী কাজ করা কি ভালো? কিন্তু এটা মুস্তাহাব। আপনার জানা তো থাকতে হবে। আপনার জানা না থাকলে সব সময় তো উল্টা করবেন। মসজিদে ঢোকার সময় ডান পা আগে দেওয়া আদব এটা মুস্তাহাব। সুন্নত। ফরয ওয়াজিব নয় কিন্তু জানা তো থাকতে হবে। জানা না থাকলে দেখা যাবে বেশির ভাগই বাম পা আগে যায়। বের হওয়ার সময় ডান পা আগে বের হয়। এটা কি মুসলিমের জন্য ভালো, সেজন্য অনেকে ধারণা করে যে, এটা তো মুস্তাহাব, এটা তো নফল, না জানলে কী হবে? আরে মুস্তাহব ও নফলের ইলম অর্জন করাও কি শুধু মুস্তাহাবই, না একটি জরুরি কাজ?
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.