Al-ihda Academy

কীভাবে দ্বীনের পথে অগ্রসর হব!

Share:

 

الحمدُ للهِ وسلامٌ على عبادِهِ الذينَ اصْطفى، أما بعد

আজ আমি শুধু দু-একটা কথা আরয করতে চাই। এমনিতে জেনারেল শিক্ষিত ভাইদের সাথে যখনই আমার খুসূসী মজলিসের সুযোগ হয়যেমন আজ হলতখন দু-একটা কথা বলে থাকি। 

আজও দুটি কথা বলতে চাই।

এক. নিজের ইলমের বিষয়ে করণীয়।

দুই. নিজের ঘর ও পরিবারের বিষয়ে করণীয়। 

ইলমের বিষয়ে কথা হলআমাদের যে ইলম অর্জন করা প্রয়োজনতা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাশাআল্লাহজেনারেল শিক্ষিতদের অনেকের মধ্যেই দ্বীনী বইপত্র পড়ার একটা আগ্রহ থাকে। কিন্তু অনেকের মধ্যে দেখা যায়পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণারও একটা মানসিকতা ও প্রবণতা তৈরি হয়। এটা আসলে কোনো হিসাবেই আসে না। কেন যে মানুষ এমন চিন্তা করেবুঝে আসে না। গবেষণা তো এমন জিনিসযার জন্য অনেক শর্ত-শারায়েত রয়েছে। আজ থেকে অনেক বছর আগে ২০০৫ সালে মাসিক আলকাউসারে গবেষণা : অধিকার ও নীতিমালা’ শিরোনামে একটা প্রবন্ধ ছেপেছে। ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সংখ্যা ছিল মাসিক আলকাউসারের প্রথম সংখ্যা। সেই সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছিল এই লেখা।

ভাই! গবেষণার একটা নিয়ম-নীতি আছে। আছে তার জন্য শর্ত-শারায়েতও। আমাদের পাশে উপবিষ্ট আমাদের এই ভাই যেই বিষয়ে পিএইচডি করেছেনআমি যদি কোনো রকম ইংরেজি শিখেই তাঁর বিষয়ে গবেষণা শুরু করিতাঁর বিষয়ে তাঁর অংশীদার হয়ে যাই– ব্যাপারটা কেমন হবে?!

মানুষ মনে করেদ্বীনী বিষয়ে গবেষণার অধিকারটা ব্যাপক। কেবল অন্যান্য জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যার যে সাবজেক্ট তিনি সেই সাবজেক্টে গবেষণা করবেনকিন্তু দ্বীনের বিষয়ে যোগ্যতা থাকুক আর না থাকুকশর্ত-শারায়েত পূর্ণ করুক আর না করুকনীতিমালার আওতায় আসুক না আসুক– গবেষণা এখানে সবাই করতে পারবে।

আসলে দ্বীনী বিষয়ে জানামানা এবং আমল করার বিষয়টা সবার জন্য। কিন্তু যেই অংশটা গবেষণারসেটা সবার জন্য নয়। অন্যান্য সাবজেক্টে যেমন গবেষণা বিশেষ গুণাবলি এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যএখানেও তেমনবরং আরও বেশি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য।

মনে রাখবেনএখানের গবেষণা জাগতিক অন্যান্য গবেষণার তুলনায় কোনোভাবেই সহজ নয়। এই বিষয়ে আজ আর কথা লম্বা করছি না। মাসিক আলকাউসারের ওই লেখাটা পড়ে নিলে আশা করি ভালো হবে।

দ্বিতীয় কথা হলদ্বীনদারী নিজের মধ্যে আনা এবং পরিবারের মধ্যে আনা। দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে কারও হয়তো কোনো আল্লাহওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। কারও হজে¦র মাধ্যমে শুরু হয়েছে। কারও চিল্লার মাধ্যমে শুরু হয়েছে। কারও ছেলেকে মাদরাসায় দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছে। যার দ্বীনদারী যেভাবেই শুরু হয়েছেসেজন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা চাই। দ্বীনদারী শুরু হওয়ার পর কিছু বিষয়ের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে  মনোযোগ দিতে হয়।

এক. পেছনের যিন্দেগীর কাফফারা

অনেকে দ্বীনদারী শুরু হওয়ার পর কেবল সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেপেছনের দিকে তাকায় না। নিয়ম হলপেছনে যা যা আমি সমস্যা করেছিতার মধ্যে কোন্ কোন্ বিষয়ের ক্ষতিপূরণ আছে– খুঁজে বের করা। যেগুলোর ক্ষতিপূরণ নেইসেগুলোর জন্য শুধু তাওবা ও ইস্তিগফার করা। কিন্তু যেগুলোর ক্ষতিপূরণ আছেঅর্থাৎ তার ক্ষতিপূরণ সম্ভবসেগুলোর ক্ষতিপূরণের চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কাফফারা থাকলে কাফফারা। কাযা থাকলে কাযা। ক্ষমা চাওয়ার হলে ক্ষমা চাওয়া। কারও হক নষ্ট করে থাকলে সেটা আদায় করে দেওয়া। গোনাহ্ তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে ক্ষমা হবেকিন্তু অন্যের হক যে নষ্ট করা হয়েছেসেটা কীভাবে ক্ষমা হবে? ‘হক’ তো গোনাহ নয়; ‘হক’ নষ্ট করাই না গোনাহ। কাজেই হক নষ্ট করার জন্য আলাদা তাওবা-ইস্তিগফার করব। কিন্তু যার হক নষ্ট করেছি বা নষ্ট করা হয়েছেসেটা তো তাকে আদায় করে দিতে হবে।

আবারো বলছিহক নষ্ট করা গোনাহ। এই নষ্ট করার কারণে যে গোনাহ হয়েছে সেটা তাওবা-ইস্তিগফারের কারণে ক্ষমা হবেকিন্তু হকমাফ হবে কীভাবেসেটা তো যার হক তাকে পৌঁছে দিতে হবে। পাওনা থাকলে আদায় করে দিতে হবে। জুলুম করে থাকলে মাজলুমের নিকট ক্ষমা চেয়ে নিতে হবেদ্বীনদারী শুরু হওয়ার পর এভাবে পেছনের দিকে তাকানো আমার প্রথম দায়িত্ব।

দুই. পরিবারের দ্বীনদারী শুরুর ক্ষেত্রে তাড়াহুড়োবাড়াবাড়ি বা জোরাজুরি নয়

দ্বিতীয় দায়িত্ব হলনিজের মধ্যে দ্বীনদারী শুরু হওয়ার পর প্রথমে সবার মধ্যেই একটা জযবাস্পৃহা ও আগ্রহ আসে। তখন সে চায়ঘরের সকল সদস্য এখনই তার মতো হয়ে যাক। সবাই তার সঙ্গে জুড়তে থাকুক। নিজে যেমন জুড়েছিসবাই আমার সঙ্গে জুড়ুকএই আশা করা ভালোকিন্তু এ জন্য জবরদস্তি করা ভালো নয়। এটা খুব জরুরি।

মাঝেমধ্যেই কয়েকজন মুরব্বী প্রফেসরের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা হয়। তাদেরকে যে কীভাবে বুঝাই! তার পরও ইকরাম ও মহব্বতের সাথে যদ্দুর পারি বলি, ‘চাচাআপনি কবে শুরু করেছেনআপনি তো এই কদিন আগেই শুরু করলেন। এত বছর তো আপনারও খেয়াল ছিল না। আল্লাহ আপনাকে তাওফীক দিয়েছেনআপনি এখন শুরু করেছেনকিন্তু এটা কেন চান যেপরিবারের সবাই এখনই শুরু করুকএখনই হয়ে যাক এবং সেটা আমার মাত্রায় হোককেনসবর করতে পারেন নাআপনি আপনার পেছনের কাফফারা তাদের মাধ্যমে ওঠাতে চাচ্ছেন নাকিআপনি বরং নিজেকে দিয়ে ওঠান! আপনি যত ভালো থেকে ভালো হওয়া সম্ভবহতে থাকুন। অন্যদের বলতে থাকুনবুঝাতে থাকুন এবং সুযোগ দিন। নিজের মধ্যে সহনশীলতা থাকতে হবে।

এটা তো আপনার হাতে না যেআপনি হুকুম দেবেন আর হয়ে যাবে। বরং এর জন্য সবার চেষ্টা যেমন থাকতে হবেআল্লাহর রহমতও থাকতে হবে। কাজেই এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি এবং তাড়াহুড়ো করা কখনোই কাম্য নয়। আমি আমার সন্তানের ঈমান-আমল এবং দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে তারাক্কি চাইবকিন্তু তাড়াহুড়োবাড়াবাড়ি ও জোরাজুরি করব না।

তারাক্কির দুটি দিক। করণীয়গুলো করা আর বর্জনীয়গুলো বর্জন করা। ভালো কাজগুলো করতে হবেমন্দকাজ এবং বদঅভ্যাসগুলো ছাড়তে হবে। করণীয়গুলো করা এবং বর্জনীয়গুলো বর্জন করাউভয়টার জন্যই সবরের প্রয়োজন। সবর যদি আমি না করি তাহলে আমার দ্বারা পরিবারের মধ্যে কেবল ভেজালই বাঁধবে। দ্বীন-ঈমানের মধ্যে তারাক্কির কথা শরীয়ত বলেকিন্তু পরিবারে ভেজাল লাগানোর কথা শরীয়ত বলে না। আমার আচরণের কারণে যদি পরিবারে মনোমালিন্য ও দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকেবোঝা গেল আমি ঈমানী তারাক্কির জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করছিআমার এই প্রক্রিয়া সহীহ নয়। এর জন্য প্রয়োজনে আলেমদের শরণাপন্ন হই। তাঁদের কাছে যাই। বোঝার চেষ্টা করি। জানা ও মানার চেষ্টা করি। অবশ্যই আমার প্রক্রিয়ায় কোথাও ভুল আছে। কারণ আমাকে যেমন দ্বীন-ঈমানী তারাক্কির জন্য নির্দেশ করা হয়উৎসাহ দেওয়া হয়সাথে একথাও বলা হয় যেইকরাম ও মহব্বতের চর্চা করা। মনগুলো যাতে মিলে থাকেসবার বোঝাপড়াটা যাতে সুন্দর হয়সেই চেষ্টাটাও করা। কিন্তু আমার দ্বারা তো সেটা হচ্ছে না। আমি ঈমানী তারাক্কির জন্য কেন সবার মন খারাপ করে দিচ্ছিবোঝা গেল আমার প্রক্রিয়াতে কোনো ত্রুটি আছে।

এই ধরনের মজলিস পেলে আমি এ কথাটা বলি যেআমাকে সবর করতে হবে। সময় দিতে হবে। সহনশীল হতে হবে। আমার যে জযবা এসেছেসেটা তার মধ্যে এলে সেও এমন হয়ে যাবে– ইনশাআল্লাহ।

অনেক ঘরে উল্টোও তো হয়। স্ত্রী এবং বাচ্চা-কাচ্চাদের মধ্যে ঈমানী জযবা এসে গিয়েছেকিন্তু স্বামীর মধ্যে এখনো আসেনি। স্ত্রী যদি আমার মতো লড়াই শুরু করেঅবস্থা কোন্ দিকে যাবেকরেও অনেকে। স্ত্রী স্বামীর সাথে লড়াই করতে থাকে। তখন লাগে ঝগড়া। আমাদের কাছে মাসআলা আসে তো।

এজন্য বিষয়টার প্রতি আমরা লক্ষ করি। আমি দুআর মাধ্যমে চেষ্টা করব। ইকরামের মাধ্যমে চেষ্টা করব এবং সবর করব। দৈনিকই যদি বারবার বলতে থাকিআল্লাহ না করুনতাহলে হিতে বিপরীতও হয়ে যেতে পারে।

তিন. জাসূসী ও গোয়েন্দাগিরি নয়

আরেক বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রীর সাথে জাসূসী ও গোয়েন্দাগিরি করতে নেই কখনো। আমি যখন অফিসে চলে যাইসে তো ঘরে তখন একা থাকেতখন সে কী করেকথার কথা তার কাছে মোবাইল আছে, (যদিও সব ধরনের মোবাইল সবার বাসায় থাকা উচিত নয়কিন্তু স্বাভাবিক কথা বলার জন্য ঘরে একটা মোবাইল থাকা ভালো। যেটাতে নেট সংযোগ দেওয়া যায় না বা স্মার্টফোন নয়। হালকা একটা মোবাইল ঘরে থাকা ভালো।) এখন আপনার সন্দেহ হচ্ছেআমি যখন অফিসে চলে যাই সে মোবাইলে কী করে! লুকিয়ে লুকিয়ে আপনি তার মোবাইলটা দেখলেনকার সাথে আজ কথা বলেছেকতক্ষণ বলেছেযাচাই করলেন– এসব উচিত নয়। এগুলো খুবই ঘৃণিত কাজ। সে আপনার মোবাইল চেক করাআপনি তার মোবাইল চেক করা যেআমার অগোচরে  কী করেকার সাথে কথা বলে– এমন জাসূসী করা একেবারে নিষিদ্ধ।

কেন এত বুযুর্গি দেখান আপনিএই বুযুর্গির কথা শরীয়ত বলে না। হাঁসবাই তাকওয়া অবলম্বন করি এবং একে অপরের প্রতি সুধারণা রাখি। কিন্তু খামোখা বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া সন্দেহ করবেন কেনএই এখান থেকেও অনেক পরিবারে ঝামেলা শুরু হয়। কাজেই এগুলোর প্রয়োজন নেই। বরং সবাই তাকওয়া অবলম্বন করব এবং একে অপরের প্রতি সুধারণা পোষণ করব।

চার. সব বিষয়ে জোর-জবরদস্তি করতে নেই

এরকম খুঁটিনাটি অনেক বিষয়াদি থাকে। যেমন কোনো একটা নফল বা মুস্তাহাব আমলের জন্য খুব বাড়াবাড়ি করা হয়। কেন আপনি বাড়াবাড়ি করছেনআপনি তাহাজ্জুদ পড়া শুরু করেছেনএখন তাকেও তাহাজ্জুদের জন্য জোর করে ওঠাবেনকেন এমন করছেনবরং সে শুয়ে থাকুক। হাঁতাকে ফজরের জন্য ওঠান। আর তাহাজ্জুদের জন্য তাকে শুধু বলতে পারেন। সে যদি নিজে থেকে বলেআমাকেও তাহাজ্জুদের সময় উঠিয়ে দিয়োতাহলে আপনি ওঠাবেন। কিন্তু জোর-জবরদস্তি করে উঠিয়ে দেবেন– এটা হয় না।

তদ্রূপ কোনো একটা খারাপ অভ্যাস ছাড়তে হবেযেটা হয়তো হারাম পর্যায়ের কিছু নয়। হারাম পর্যায়ের কোনো অভ্যাস তার থেকে দূর করতে হলেও তো আপনাকে সবর করতে হবে। কিন্তু যেটা হারাম পর্যায়ের নয়বরং এমনিতে আপনার কাছে এটা পছন্দ নয় বা আপনার শায়েখ এটা পছন্দ করেন না। এখন এই অপছন্দ’-এর জন্য আপনি তার ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন– তা হয় না।

মোটকথাআমাদের ভারসাম্য শিখতে হবে। আর সেজন্যই আমাদের আলেমদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাতাদের সঙ্গে মশওয়ারা ও মুযাকারা করা অত্যন্ত জরুরি। যেসব কিতাব অধ্যয়নে এসব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়ের বুঝ সৃষ্টি হয়যেখানে এই ধরনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় থাকেযেমন মুফতী তাকী উসমানী দা. বা.-এর কিতাবগুলো– সেগুলোও বার বার পড়া।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন– আমীন।

وآخرُ دعْوانا أنِ الْحَمْدُ للهِ ربِّ العالَمِيْن

Share:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *