Al-ihda Academy

মাহে রমযানুল মুবারক তাকওয়ার দীপ্তিতে উজ্জিবীত হোক মুমিনের জীবন

Share:

মাহে রমযানুল মুবারক
তাকওয়ার দীপ্তিতে উজ্জিবীত হোক মুমিনের জীবন

মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

 

মাহে রমযানুল মুবারক। শ্রেষ্ঠত্ব মহিমা ও অফুরন্ত ফযীলতে উদ্ভাসিত একটি মাস। মুমিনের বহুল প্রতীক্ষিত এই পবিত্র রমযানুল মুবারক আগমন করে রহমত বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে। বার্তা দিয়ে যায় সৌহার্দ সম্প্রীতি ও ভালবাসার। গোটা রমযানজুড়ে বয়ে যায় মুমিন জীবনে ঈমানী বসন্তের অবারিত সমীরণ। এ মাসকে ঘিরে সে সঞ্চয় করে গোটা বছরের ঈমানী আমলী ও রূহানী পাথেয়। অর্জন করে তাকওয়া ও খোদাভীরুতার বৈশিষ্ট্য। ধন্য হয় মহান রবের নৈকট্য ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে। কিন্তু কীভাবেআজ আমরা সে বিষয়েই কিছু মুযাকারা করার প্রয়াস চালাব– ইনশাআল্লাহ।

রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। খায়ের ও বরকতের মাস। তাকওয়া অর্জন ও আমলে অগ্রগামী হওয়ার মাস। নেকী হাছিলের মাস। গুনাহ বর্জন এবং ক্ষমা লাভের মাস। প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরার এবং সংযম সাধনার মাস। ভ্রাতৃত্ব চর্চার মাস। দয়া ও সহানুভূতির মাস। দেহমন শুদ্ধ ও পবিত্র করার মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ পাকের রহমত ও করুণা বান্দার প্রতি অধিক নিবিষ্ট হয়নেক ও কল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়া সহজ হয়। জাহান্নামের কপাটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এ মাসে। গুনাহের তাড়না দমিত হয়। শয়তান এ মাসে শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে। এ মাসে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্ত করে থাকেন জাহান্নামের আগুন থেকে।

অতএব এ মাস আল্লাহমুখী হওয়াতাঁর প্রিয়পাত্র হওয়াতাকওয়া হাছিল করা এবং গুনাহ থেকে পাকছাফ হয়ে তাঁর নৈকট্য অর্জনের মোক্ষম সময়। কীভাবে বেশি থেকে বেশি আমলের মাধ্যমে নিজের ঈমানী যিন্দেগী দ্যুতিময় করে তোলা যায় এ মাস হল সেই চর্চা ও প্রচেষ্টার উপযুক্ত মুহূর্ত। আর তাই তো রমযানের চাঁদ উঠতেই ঘোষণা হতে থাকে

يَا بَاغِيَ الخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشّرِّ أَقْصِرْ.

ওহে কল্যাণ অন্বেষীতুমি সুসংবাদ গ্রহণ করনেকীর পথে তুমি আরো বেগবান হও। ওহে অকল্যাণের যাত্রীতুমি  নিবৃত্ত হওনিয়ন্ত্রিত হও। জামে তিরমিযীহাদীস ৬৮২সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৬৪২মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৮৭৯৫২৩৪৯১

মাহে রমযানে যেকোনো ধরনের নেক ও কল্যাণের প্রতি ধাবিত হওয়ার রয়েছে বিশেষ ফযীলত। তবে আমরা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে বিশেষ কিছু আমলের কথা উল্লেখ করবযা এ মাসের কারণে অধিক তাৎপর্য ধারণ করে।

এক. গুরুত্ব দিয়ে রোযা রাখা

ইসলামের মৌলিক পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে রমযান মাসে রোযা রাখা। রোযা রাখা এ মাসের মূল আমল। আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর রমযানে মাসব্যাপী রোযা রাখা ফরয করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.

হে ঈমানদারগণতোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছেযেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিলযাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। সূরা বাকারা (২) : ১৮৩

তো দেখা যাচ্ছেরোযার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাকওয়া হাছিল করা। তাই আমার রোযা যেন আমার তাকওয়া হাছিলের উপলক্ষ হয়– এজন্য খুব গুরুত্বের সাথে রোযা রাখতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِه.

যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে রমযান মাসে রোযা রাখবেতার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। সহীহ বুখারীহাদীস ৩৮

তো ঈমান ও ইহতিসাবের উপলব্ধি জাগ্রত রেখে রোযা রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল এবং বান্দার গুনাহ মাফের একটা বড় মাধ্যম।

আল্লাহ তাআলার নিকট বান্দার রোযা অত্যন্ত প্রিয়। রোযা ও রোযাদারের ব্যাপারে হাদীসে কুদসীতে চমৎকার বিবরণ এসেছে

قَالَ اللهُكُلّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ، إِلّا الصِّيَامَ، فَإِنّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، وَالصِّيَامُ جُنّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ .وَالّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِلِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَاإِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ، وَإِذَا لَقِيَ رَبّهُ فَرِحَ بِصَوْمِه.

আল্লাহ তাআলা বলেনবনী আদমের সকল আমল তার নিজেরকিন্তু রোযা ব্যতিক্রম। রোযা কেবল আমার। আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। রোযা ঢালস্বরূপ। যখন তোমাদের রোযার দিন আসে তখন তোমরা অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং চিৎকার চেঁচামেচি করবে না। কেউ যদি ঝগড়া বিবাদে প্রবৃত্ত হয় তাহলে সে (নিজেকে নিবৃত্ত রাখবে এবং মনে মনে) ভাববে আমি রোযাদার (প্রয়োজনে মুখে বলে দেবে)। ওই সত্তার কসমযার কব্জায় মুহাম্মাদের প্রাণরোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেসকের সুগন্ধি অপেক্ষা অধিক প্রিয়। রোযাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হলযখন সে ইফতার করে পুলকিত হয়। অপরটি হলযখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন রোযার প্রতিদান পেয়ে খুশি হয়ে যাবে। সহীহ বুখারীহাদীস ১৮৯৪১৯০৪৭৪৯২সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৫১

এজন্য খুব গুরুত্বের সাথে রোযা রাখতে হবেযাতে আমার রোযা আমার তাকওয়ার উপলক্ষ হয়আমার গুনাহ মাফের মাধ্যম হয় এবং আমার রবের সন্তুষ্টির কারণ হয়। হাদীসে রোযাকে ঢাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমার এ ঢাল যেন অক্ষত থাকেতা বিদীর্ণ না হয়। হাদীসে  এসেছেগীবত শেকায়েত মিথ্যা গালাগালি ইত্যাদির মাধ্যমে এ ঢাল নষ্ট হয়ে যায়। (আলমুজামুল আওসাততবারানীহাদীস ৪৫৩৬)

শরীয়তে ইসলামীর প্রতিটি আমল ও বিধানের দুটি দিক রয়েছে। বাহ্যিক কানুনী ও আইনি দিক। অপরটি হচ্ছে রূহানী ও আধ্যাত্মিক দিক। রোযার ক্ষেত্রেও তাই। অনেকসময় খেয়াল না করার কারণে কেবল কানুনী বিবেচনাটাই মুখ্য হয়ে থাকে। ফলে দেখা যায়দিনভর পানাহার থেকে বিরত থাকল বটেতবে রোযা তার জন্য না ঢাল হলআর না সে রোযার মাধ্যমে তাকওয়ার কাক্সিক্ষত স্তরে উন্নীত হতে পারল। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزّورِ وَالعَمَلَ بِهِ وَالجَهْلَ، فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ.

যে মিথ্যা ও মূর্খসুলভ বক্তব্য ও আচরণ ছাড়ল নাতার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। সহীহ বুখারীহাদীস ৬০৫৭

নবীজী আরো বলেন

كَمْ مِنْ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلّا الْجُوعُ، وَكَمْ مِنْ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلّا السّهَرُ.

এমন অনেক রোযাদার রয়েছেক্ষুৎপিপাসার কষ্ট ব্যতীত তাদের রোযায় কিছু থাকে না। আবার এমন অনেক রাতের ইবাদতগুজার রয়েছেরাত্রিজাগরণের কষ্ট ব্যতীত তাদের কিছুই লাভ হয় না। মুসনাদে আহমাদহাদীস ৯৬৮৫সুনানে দারেমীহাদীস ২৭৬২

অতএব রোযা কেবল দুই অঙ্গের নয়। হাতপাচোখকানমুখ এবং মন মানসসহ শরীরের সকল অঙ্গের ক্ষেত্রেও রোযার আবেদন রক্ষা করা জরুরি। এমন যেন না হয় যেমনটি বর্ণর্নায় এসেছে। অর্থাৎ ওই দুই নারীযারা রোযা অবস্থায় গীবত করেছিল। তখন তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে

إِنّ هَاتَيْنِ صَامَتَا عَمّا أَحَلّ اللهُ لَهُمَا، وَأَفْطَرَتَا عَلَى مَا حَرّمَ اللهُ عَلَيْهِمَا.

এরা দুজন তো এমন বিষয় থেকে বিরত থেকেছে (অন্য সময়ের জন্য) আল্লাহ যা হালাল করেছেন। কিন্তু ঐসব কাজ থেকে বিরত থাকেনিযা আল্লাহ (সবসময়ের জন্য) হারাম করেছেন (অর্থাৎ গীবত)। মুসনাদে আহমাদহাদীস ২৩৬৫৩

মোটকথাতাকওয়া ও ক্ষমা লাভের প্রতিবন্ধক বিষয়গুলোকে বর্জন করে তাকওয়া অর্জনে এগিয়ে এলে তবেই রোযা ঢাল এবং তাকওয়া অর্জনে সহায়ক হবেইনশাআল্লাহ।

দুই. গুরুত্ব সহকারে তারাবীহ পড়া এবং তাহাজ্জুদের প্রতি যত্নবান হওয়া

রমযানুল মুবারকের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছেকিয়ামে রমযান তথা ইবাদতের মাধ্যমে রমযানের রাতকে প্রাণবন্ত রাখা। রমযান মাসের রাতের সকল ইবাদত বন্দেগী– তারাবীহতাহাজ্জুদযিকিরতিলাওয়াতদুআ দরূদ ইত্যাদি আমল গুরুত্বের সাথে আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে কিয়ামে রমযান করবে তার বিগত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সহীহ বুখারীহাদীস ২০০৯সহীহ মুসলিমহাদীস ৭৫৯

রমযানের জন্য নির্ধারিত যে বিশেষ আমলটি রয়েছে তা হচ্ছে সালাতুত তারাবীহ। রাতে এশার নামাযের পর বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া নারী পুরুষ সকলের জন্য সুন্নতে মুআক্কাদাহ। বস্তুত তারাবীহ রমযানের এমন একটি আমলচাঁদ ওঠার পর সর্বপ্রথম যার মাধ্যমে রমযানের আনুষ্ঠানিক পর্ব শুরু হয়। তাই তারাবীহের ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান হওয়া চাই। আর খতমে তারাবীহের প্রতি আগ্রহী হওয়া তো আরো সওয়াবের বিষয়।

অবশ্য ইদানীং তারাবীহের রাকাত সংখ্যা নিয়ে এক ধরনের বাদানুবাদ তৈরি করা হয়ে থাকেযা আদৌ কাম্য নয়। দালীলিকভাবে এটাই সুসাব্যস্ত যেতারাবীহ বিশ রাকাত। এ বিষয়ে আলকাউসারের বিগত সংখ্যাগুলোতে বহুবার প্রামাণিক আলোচনা হয়েছে। তাই আটবিশের’ বিবাদে জড়িয়ে রমযানের বরকতপূর্ণ সময়গুলো নষ্ট করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

তেমনিভাবে বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় রমযান মাসে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। তাহাজ্জুদের মুহূর্তটি একটি মহিমান্বিত মুহূর্ত। এ সময় আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি নিবিষ্ট থাকে। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে ডেকে ডেকে বলতে থাকেন

مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.

আছে কি কেউযে আমাকে ডাকবেঅমি তার ডাকে সাড়া দিব। কেউ আমার কাছে কিছু চাইবেআমি তাকে তা দিয়ে দিব। কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেআমি তাকে ক্ষমা করে দিব।

অর্ধ রজনী অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে ফজর পর্যন্ত প্রতি রাতে রাব্বুল আলামীন এভাবে বান্দাকে ডাকতে থাকেন। (দ্র. সহীহ বুখারীহাদীস ৬৩২১সহীহ মুসলিমহাদীস ৭৫৮)

বান্দার এ সময়ের ইবাদত আল্লাহর নিকট অতি প্রিয়। নবীজী বলেন

أَفْضَلُ الصّلَاةِ بَعْدَ الصّلَاةِ الْمَكْتُوبَةِ، الصّلَاةُ فِي جَوْفِ اللّيْلِ.

ফরয নামাযের পর মধ্যরাতের নামায সর্বোত্তম। সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৬৩

রমযানের রহমত ও মাগফেরাতের সাথে যদি যুক্ত হয় মধ্য রাতের এ খোশখবরিমহান রবের পক্ষ থেকে অসীম দয়া ও অপার ক্ষমার অবারিত ঘোষণা! মুমিনের জন্য কি এরচে মোক্ষম মুহূর্ত আর হতে পারে! তাই রমযান মাসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তাহাজ্জুদের প্রতি মনোযোগী হওয়াটাই মুমিনের শান। রমযানে তো এমনিতেই সাহরীর জন্য উঠতে হয়। তাহলে আমি কি পারি না আরেকটু আগে উঠে জায়নামাযে দাঁড়াতে! আল্লাহর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়তে! রাহমানুর রাহীম দেওয়ার জন্য ডেকে যাচ্ছেন। আমার কি আকাক্সক্ষা হয় না তাঁর থেকে কিছু নেই! আমি অসহায়ের কি প্রয়োজন নেই মাবূদের নিকট কিছু চাওয়ার! তাঁর মাগফিরাত লাভ করার!!

রমযান মাসে যদি তাহাজ্জুদের অভ্যাস তৈরি করা যায় তাহলে বাকি এগার মাস সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবেইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।

বলার অপেক্ষা রাখে নাযেখানে তারাবীহতাহাজ্জুদের নামায এত গুরুত্বের সাথে আদায় করতে বলা হচ্ছেসেখানে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায আরো কত গুরুত্ব দিয়ে জামাতের সাথে আদায় করতে হবে!

তিন. কুরআনের সাথে সম্পর্ক মজবুত করা

রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। আল্লাহ তাআলা এ মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। আল্লাহ বলেন

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ ۚ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ .

রমযান মাসযে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছেযা মানুষের জন্য (আদ্যোপান্ত) হেদায়েত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিতযা সঠিক পথ দেখায় এবং (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবেসে যেন এ সময় অবশ্যই রোযা রাখে। সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

অতএব এ মাস কুরআনের সাথে সম্পর্ক মজবুত ও নিবিড় করার মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনিতেই নেক ও কল্যাণের ক্ষেত্রে উদার এবং অগ্রগামী ছিলেন। রমযান মাসে এক্ষেত্রে নবীজী আরো অগ্রগামী হতেন। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে নবীজীর নিকট আসতেন। জিবরীল নবীজীকে কুরআন শোনাতেন এবং নবীজীও তাকে পুরো কুরআনুল কারীম পড়ে শোনাতেন। বৃষ্টির পূর্বে যেভাবে শীতল হাওয়া পুরো পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে নেয় রমযানে জিবরীল আ.এর আগমনের পর নবীজী কল্যাণ অন্বেষণের ক্ষেত্রে এর চেয়েও উদার হয়ে পড়তেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ১৯০২)

ইমাম বুখারী (তালীকান) উল্লেখ করেনহযরত ফাতেমা রা. বলেন– নবীজী আমাকে চুপি চুপি বলেছেনজিবরীল প্রতি বছর আমাকে কুরআন শোনায়। এ বছর আমাকে সে দুবার শুনিয়েছে। আমার মনে হয়আমার সময়’ চলে এসেছে। (দ্র. সহীহ বুখারীঅধ্যায় : জিবরীল নবীজীকে কুরআন শোনানো।)

তাই তিলাওয়াতে কুরআনতাদাব্বুরে কুরআন (কুরআনের আয়াত ও হেদায়েত নিয়ে চিন্তা ফিকির করা) ও আমল বিল কুরআনের মাধ্যমে এ মাসকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখা ঈমানদারের কর্তব্য।

চার. দুআদরূদ ও তওবাইস্তিগফারের প্রতি মনোযোগী হওয়া

দুনিয়াবী অন্যান্য ঝামেলা কমিয়ে এ মাসে আমলের প্রতিযিকির আযকার ও তওবা ইস্তিগফারের প্রতি মনোযোগী হওয়াবিশেষভাবে কুরআন নিয়ে মশগুল থাকা এ মাসের অন্যতম মৌলিক আমল।

রমযান মাস যেহেতু ক্ষমাপ্রাপ্তির মাস তাই আমার মাগফিরাত লাভ হচ্ছে কি না সেদিকে খুব গভীর খেয়াল রাখা দরকার। ওইসমস্ত আমলের প্রতি মনোযোগি হওয়া দরকারযেগুলো আল্লাহর রহমত লাভে সহায়ক হয়। ওইসকল পাপাচার থেকে দূরে থাকাযা আল্লাহর ক্রোধকে জাগিয়ে দেয়। তবেই ক্ষমার আশা করতে পারি। গোটা রমযান মাসজুড়েই থাকে ক্ষমাপ্রাপ্তির অফুরন্ত ঘোষণা। তথাপি শেষ রাতেইফতারের সময়ইতিকাফ অবস্থায়লাইলাতুল কদরে ইত্যাদি মুহূর্তগুলোতে দুআ কবুল ও ক্ষমাপ্রাপ্তির অধিক আশা করা যায়।

কাজেই দুআ দরূদ ও তওবা ইস্তিগফারের প্রতি মনোনিবেশ করি। দরবারে ইলাহীতে কান্নাকাটি ও রোনাযারির নাযরানা পেশ করার অভ্যাস করি। তাহলে আমার রবের রহমত আমার প্রতি আরো ধাবিত হবেইনশাআল্লাহ।

এ মুহূর্তে মনে করি নবীজীর হাদীস। হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত

أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ رَقَى الْمِنْبَرَ، فَلَمّا رَقَى الدّرَجَةَ الْأُولَى قَالَآمِينَ ، ثُمّ رَقَى الثّانِيَةَ فَقَالَآمِينَ، ثُمّ رَقَى الثّالِثَةَ فَقَالَآمِينَ، فَقَالُوايَا رَسُولَ اللهِ، سَمِعْنَاكَ تَقُولُآمِينَ ثَلَاثَ مَرّاتٍ؟ قَالَلَمّا رَقِيتُ الدّرَجَةَ الْأُولَى جَاءَنِي جِبْرِيلُ فَقَالَشَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ رَمَضَانَ، فَانْسَلَخَ مِنْهُ وَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ، فَقُلْتُآمِينَثُمّ قَالَشَقِيَ عَبْدٌ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنّةَ، فَقُلْتُآمِينَثُمّ قَالَشَقِيَ عَبْدٌ ذُكِرْتَ عِنْدَهُ وَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ، فَقُلْتُآمِينَ.

নবীজী একবার মিম্বরে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেনআমীন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে উঠেও বললেনআমীন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন (কী বিষয় আল্লাহর রাসূল!) আপনাকে (এভাবে) আমীন বলতে শুনলাম। তখন নবীজী বললেনআমি যখন মিম্বরে আরোহণ করলাম তখন জিবরীল আগমন করলেন এবং বললেনওই ব্যক্তি হতভাগাযে রমযান মাস পেলআর রমযান গত হয়ে গেল কিন্তু তার গোনাহ মাফ হল না। আমি বললামআমীন। তারপর বললওই ব্যক্তি হতভাগাযে তার মাবাবাকে অথবা কোনো একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেল অথচ তারা (মাবাবা) তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না (অর্থাৎ তাদের খেদমতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না।) আমি বললামআমীন। তৃতীয় বার বললেনওই ব্যক্তি হতভাগাযার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হল আর সে আপনার উপর দরূদ পাঠ করল না। বললামআমীন। আলআদাবুল মুফরাদবুখারীহাদীস ৬৪৪মুসনাদে আহমাদহাদীস ৭৪৫১

পাঁচ. গুরুত্ব দিয়ে ইফতার ও সাহরী করা ও করানো

রোযার নিয়তে সুবহে সাদিকের পূর্বে যে খাবার গ্রহণ করা হয় তা হল সাহরী। সাহরী খাওয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

تَسَحّرُوا فَإِنّ فِي السّحُورِ بَرَكَةً.

তোমরা সাহরী কর। কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে। সহীহ বুখারীহাদীস ১৯২৩সহীহ মুসলিমহাদীস ১০৯৫

অর্থর্াৎ পার্থিব বিবেচনায় সাহরীর খাবার দিনের বেলা রোযা রাখতে শক্তি যোগায়। তেমনি পরকালীন বিবেচনাতেও এতে খায়ের ও বরকত এবং পুণ্য ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আরেক হাদীসে এসেছে

السّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ، فَلَا تَدَعُوهُ، وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ، فَإِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ .

সাহরী খাওয়াতে বরকত রয়েছে। অতএব তোমরা তা ছেড়ো নাযদিও এক ঢোক পানি পান করেও হোক না কেন। কেননা যারা সাহরী খায় আল্লাহ তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্য রহমতের দুআ করতে থাকে। মুসনাদে আহমাদহাদীস ১১০৮৬১১৩৯৬

এছাড়া আরো অনেক বর্ণনায় সাহরী গ্রহণকারীদের জন্য রহমতের দুআ এসেছে।

সাহরী করা যেমন মুস্তাহাব তেমনি তা ওয়াক্তের শেষ দিকে করাও উত্তম। অর্থাৎ সতর্কতামূলক সময় হাতে রেখে সুবহে সাদিকের পূর্বনিকটবর্তী সময়ে সাহরী করা ভালো। নবীজী বলেন

إِنّا مَعَاشِرَ الْأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا أَنْ نُعَجِّلَ فِطْرَنَا، وَأَنْ نُؤَخِّرَ سَحُورَنَا.

আমরা নবীগণ এ মর্মে আদিষ্ট হয়েছি যে, (সময় হওয়ার পর) ইফতারী তাড়াতাড়ি করব এবং (সময় থাকতে থাকতে) সাহরী বিলম্ব করব। আলমুজামুল আওসাততবারানীহাদীস ১৮৮৪মাজমাউয যাওয়ায়েদহাদীস ৪৮৮০

সাহাবায়ে কেরামের আমলও এরকম ছিল। হযরত আমর ইবনে মাইমুন আলআউদী রাহ. বলেন

كَانَ أَصْحَابُ مُحَمّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَسْرَعَ النّاسِ إِفْطَارًا وَأَبْطَأَهُ سُحُورًا.

সাহাবায়ে কেরাম (সময় হওয়ার পর) দ্রুত ইফতার করতেন আর সাহরী (সময়ের মধ্যে) বিলম্বে করতেন। মুসান্নাফে আবদুর রাযযাকবর্ণনা ৭৫৯১মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাবর্ণনা ৮৯৩২

সাহরী খেয়ে দিনভর রোযা রাখার পর রোযাদারের জন্য যে আনন্দঘন মুহূর্তটি উপস্থিত হয় তা হচ্ছেইফতারির সময়। সাধ্য অনুসারে ইফতারির আয়োজন সামনে নিয়ে রোযাদার অপেক্ষায় আছে সূর্যাস্তেরআল্লাহর হুকুমের। হাতে খাবার। পেটে ক্ষুধা। শরীর ক্লান্ত। তবুও কিছু মুখে দিচ্ছে না। কারণ এখনও আল্লাহর হুকুম হয়নি। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য! নবীজী বলেন

لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِفَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ.

রোযাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হল ইফতারের সময়। অপরটি হল যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৫১

আল্লাহ তাআলার নিকট এ দৃশ্যটি অত্যন্ত প্রিয়। বান্দার এ সময়ের এ অবস্থাকে আল্লাহ পাক বিশেষ মর্যাদা দিয়ে থাকেন। নবীজী বলেন

إِنّ لِلصّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ لَدَعْوَةً مَا تُرَدّ.

ইফতারের সময় রোযাদারের অন্তত একটি দুআ এমনযা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ কমপক্ষে একটি দুআ অবশ্যই কবুল হয়। সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৭৫৩

এ হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. ইফতারের সময় এ দুআ করতেন

اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الّتِي وَسِعَتْ كُلّ شَيْءٍ أَنْ تَغْفِرَ لِي.

আয় আল্লাহআমি আপনার সর্বব্যাপী রহমতের ওসিলা দিয়ে প্রার্থনা করছিআপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৭৫৩

এজন্য ইফতারের একটি আদব হচ্ছেসময় হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ইফতার প্রস্তুত করে আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জেহ হয়ে বসাবেশি বেশি দুআদরূদ পড়াতওবাইস্তিগফার করা।

ঘরের নারীরাও যেন ইফতারের আগের দুআইস্তিগফারে শামিল হতে পারে এজন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা করা এবং অন্যরা তাদেরকে সহায়তা করা। ইফতারের আয়োজন এক পদ কম হোককিন্তু নারীরা যেন ইফতারের আগমুহূর্তের দুআইস্তিগফার থেকে মাহরূম না হয়– এদিকে সকলের সচেতন দৃষ্টি রাখা এবং সহায়তা করা। 

ইফতারের মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। এ সময়ে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য ব্যক্তিকে মুক্তি দান করেন। নবীজী বলেন

إِنّ لِلهِ عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ، وَذَلِكَ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ.

আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তির জন্য (জাহান্নাম থেকে) মুক্তির ফয়সালা করে থাকেন এবং এটা রমযানের প্রতি রাতে ঘটে। সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৬৪৩

রমযান মাস সৌহার্দ সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার মাস। এই সৌহার্দের একটি প্রকাশ এও যেআমি কেবল আমার নয়আমার ভাইয়েরও খবর রাখব। তার খোঁজ খবর নিব। ইসলামে মেহমানদারি ও আপ্যায়নের ফযীলত অনেক। আর যদি সেই আপ্যায়ন হয় রোযাদারকে সাহরী বা ইফতারের আপ্যায়ন তাহলে তা কত মহৎ হতে পারে! রোযাদারের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা অনেক বড় সওয়াবের আমল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

مَنْ فَطّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ، غَيْرَ أَنّهُ لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصّائِمِ شَيْئًا.

কেউ যদি কোনো রোযাদারকে ইফতার করায় তাহলে সে ওই রোযাদারের সমান সওয়াব লাভ করবে। আর এতে ওই রোযাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না। জামে তিরমিযীহাদীস ৮০৭সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৭৪৬সুনানে কুবরানাসাঈহাদীস ৩৩১৬৩৩১৭মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৭০৪৪১৭০৩৩

তাই এ মাসে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের প্রতি সহমর্মিতার দৃষ্টি আরো বাড়িয়ে দেই। সবাই সবার অবস্থান থেকে কল্যাণের পথে অগ্রসর হতে থাকি। খুঁজে খুঁজে আল্লাহর বান্দাদের খোঁজ খবর রাখি।

ছয়. লাইলাতুল কদর তালাশ করা

রমযানুল মুবারকের পুরো মাসের সবচে গুরুত্বপূর্ণ যে সময়টি তা হচ্ছে লাইলাতুল কদর বা কদর রজনী। আল্লাহ তাআলা এ রাতের ব্যাপারে বলেন

لَیْلَةُ الْقَدْرِخَیْرٌ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ. تَنَزَّلُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ وَ الرُّوْحُ فِیْهَا بِاِذْنِ رَبِّهِمْ ۚ مِنْ كُلِّ اَمْرٍ،سَلٰمٌ  هِیَ حَتّٰی مَطْلَعِ الْفَجْرِ۠.

কদর রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেই রজনীতে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজে তাদের রবের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তিসেই রজনী সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। সূরা কদর (৯৭) : ৩

কাজেই এ রাতের অন্বেষণে যেমনি আগ্রহী হওয়া দরকার তেমনি এ রাতে ইবাদত বন্দেগী– নফল নামাযতিলাওয়াতযিকিরতওবা ইস্তিগফারদুআদরূদ ইত্যাদির প্রতিও আরো যত্নবান হওয়া জরুরি।

এ রাতে আল্লাহ তাআলার অবারিত রহমত ও করুণা বর্ষিত হয়। নবীজী বলেন

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

যে ব্যক্তি রমযান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর পক্ষ থেকে সওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় রোযা রাখবে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে লাইলাতুল কদরে কিয়াম (ইবাদতবন্দেগী) করবেতার পূর্বের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সহীহ বুখারীহাদীস ২০১৪

তো ঈমান ও ইহতিসাবের উপলব্ধি জাগরূক রেখে লাইলাতুল কদরে কিয়াম (ইবাদতবন্দেগী) করা বান্দার গুনাহ মাফের মাধ্যম।

একদিকে তো লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে এই খোশখবরী। অপরদিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে এত বড় পুরস্কারের ঘোষণা পাওয়ার পরও এর প্রতি আগ্রহী না হওয়াটাও অনেক বড় বঞ্চনার বিষয়। হযরত আনাস রা. বলেনরমযান এলে নবীজী বলতেন

إِنّ هَذَا الشّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ، وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلّهُ، وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلّا مَحْرُومٌ.

যে মাসে তোমরা উপনীত হয়েছ তাতে একটি রজনী রয়েছেযা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর খায়ের ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকল সে যেন সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হল। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৬৪৪সুনানে নাসাঈহাদীস ২১০৬

তাই হেলায় না কাটিয়ে কদরের রাতের কদর করার চেষ্টা করি।

কিন্তু এ রজনী কত তারিখেহাদীস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী কদরের রাতের সুনির্দিষ্ট তারিখ আমাদের জানানো হয়নি। তবে রমযানের শেষ দশকে তা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ইবাদতের মাত্রা ও পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. নবীজীর শেষ দশকের আমলের বিবরণ দিয়ে বলেন

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، مَا لَا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে অন্য দিনের তুলনায় (ইবাদতবন্দেগীতে) আরো বেশি মেহনত করতেন। সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৭৫

তিনি আরো বলেন

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ،إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ، أَحْيَا اللّيْلَ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ، وَجَدّ وَشَدّ الْمِئْزَرَ.

রমযানের শেষ দশক শুরু হলে নবীজী পূর্ণ রাত্রি জাগরণ করতেন। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন। এবং নিজে কোমর বেঁধে ইবাদতে মগ্ন হতেন। সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৭৪সহীহ বুখারীহাদীস ২০২৪

হাদীস শরীফে কদর রজনী নির্ধারিত করে দেওয়া হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলো সামনে রেখে যা বুঝে আসেলাইলাতুল কদর লাভের জন্য গোটা রমযান বিশেষ করে শেষ দশকআরো বিশেষ করে বললে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই একজন মুমিনের এর অন্বেষণে পূর্ণ সজাগ এবং প্রস্তুত থাকা চাই। নবীজী বলেন

تَحَرَّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ.

তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। সহীহ বুখারীহাদীস ২০২০

আরেক বর্ণনায় এসেছে

الْتَمِسُوهَا فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ فِي الوَتْرِ.

তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদর রজনী অন্বেষণ কর। সহীহ বুখারীহাদীস ২০১৬

যেহেতু হাদীসে লাইলাতুল কদরের তারিখ নির্ধারিত করে বলা হয়নি তাই নির্দিষ্ট কোনো রাতে নির্দিষ্ট কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাঝে তা বেঁধে ফেলা ঠিক নয়। তাই বিদআত ও রুসুমাত থেকে দূরে থেকে ব্যক্তিগতভাবে নফল ইবাদতের মাধ্যমে এ রাত যাপন করাই উত্তম।

লাইলাতুল কদর যেহেতু বিশেষ রজনীতাই এ রাতে বিশেষ কিছুই চাওয়া দরকার। কিন্তু আমি বিশেষভাবে কী চাইব এবং কীভাবে চাইবআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তাও শিখিয়ে দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. নবীজীকে জিজ্ঞাসা করেন– ইয়া রাসূলাল্লাহযদি আমি জানতে পারিআজ লাইলাতুল কদর। তো আমি কী দুআ করতে পারিনবীজী বললেনতুমি বল

اللّهُمّ إِنّكَ عُفُوّ تُحِبّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي.

আয় আল্লাহ! আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতেই ভালবাসেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। জামে তিরমিযীহাদীস ৩৫১৩

একজন মুমিনের জন্য তার রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অপেক্ষা বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!

তাৎপর্যপূর্ণ এ দুআটি কেবল লাইলাতুল কদরেই নয়পুরো রমযানেইইফতারীর সময়সাহরীর সময় এবং অন্যান্য সময়েও পড়তে পারি। নবীজীর শেখানো দুআ যত পড়ব ততই লাভ।

সাত. ইতিকাফ করা

রমযান মাসের শেষ দশক অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। রমযানের একটি বিশেষ আমল হচ্ছে সুন্নত ইতিকাফ। আর তা আদায় করার মূল সময় এটি। রমযানের খায়ের বরকত লাভে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদর লাভ করার সম্ভাবনাও থাকে বেশি। তাই নবীজী রমযানের শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করার বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এজন্য রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুআক্কাদাহ কিফায়াহ। তবে এর চেয়ে বেশি আল্লাহর ঘরে যে যত দীর্ঘ সময় অবস্থান করবে তার তত সওয়াব এবং ফায়েদা হতে থাকবে।

নবীজী প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন

أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، حَتّى تَوَفّاهُ اللهُ عَزّ وَجَلّ، ثُمّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। নবীজীর পর তাঁর পরিবারও ইতিকাফ করত। সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৭২সহীহ বুখারীহাদীস ২০২৬

হযরত আবু হুরাইরা রা. বলেন

كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ القُرْآنَ كُل عَامٍ مَرّةً، فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرّتَيْنِ فِي العَامِ الّذِي قُبِضَ فِيهِ، وَكَانَ يَعْتَكِفُ كُلَّ عَامٍ عَشْرًا، فَاعْتَكَفَ عِشْرِينَ فِي العَامِ الّذِي قُبِضَ فِيهِ.

জিবরীল প্রতি বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার কুরআন শোনাতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর দুই বার শোনান। নবীজী প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেন। সহীহ বুখারীহাদীস ৪৯৯৮২০৪৪

পূর্বে আমরা যেমনটি উল্লেখ করেছিনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে বলেছেন। কদরের খায়ের ও বরকত লাভ করার জন্য রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিকাফকারী অন্যান্য আমল করতে না পারলেও শুধু মসজিদে অবস্থান করাটাই একটা স্বতন্ত্র আমল। ইতিকাফকারী যতক্ষণ মসজিদে থাকবে ততক্ষণ তার সওয়াব হতে থাকবে। আর অন্যান্য আমলের জন্য তো ভিন্ন সওয়াব আছেই। তাই শুধু মসজিদে অবস্থান করার মাধ্যমেই সে সহজে কদরের খায়ের ও কল্যাণ লাভ করছে।

তেমনিভাবে শুধু মসজিদে অবস্থানের কারণে বাইরের বহু ফেতনা ফাসাদ থেকে সে বেঁচে যাচ্ছে। গুনাহের সয়লাবের এ যামানায় বহু গুনাহ থেকে দূরে থাকা অর্থাৎ রোযার যাবতীয় শর্ত ও আদব রক্ষা করা সহজ হয় আল্লাহর ঘর মসজিদে ইতিকাফ করার মাধ্যমে।

কর্ম ব্যস্ততা কিংবা হিম্মতের কমতি অথবা অন্য কোনো ওযর ইতিকাফের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে পুরো রমযান মাস বা শেষ দশ দিন ইতিকাফ করা যাচ্ছে না বলে যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকুও করব না– তা নয়। পূর্ণ দশ দিন সুন্নত ইতিকাফ করতে না পারলেও নফল হিসাবে যে যতটুকু পারি ততটুকুই আল্লাহর ঘরে অবস্থান করি। তাতেও অনেক ফায়দা। বিশেষ করে সারাদিনের কর্মব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়ে কমপক্ষে বেজোড় রাতগুলোতে যদি নফল ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা হয় তবুও তো কদরের রহমত বরকত লাভের আশা করা যায়। তাই পুরো সময় না পারলেও যে যতটুকু পারি ততটুকু সময় মসজিদের পরিবেশে থাকি। এটাও আমার জীবনে অনেক কল্যাণ বয়ে আনবে।

নারীগণ যদি সাংসারিক ব্যস্ততা থেকে ফারেগ থাকেনঘরে অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা বাচ্চাকাচ্চার সেবাশুশ্রƒষা বা দেখাশোনা করার প্রসঙ্গ নেই তাহলে তারাও ইতিকাফ করতে পারেন। স্বামী উপস্থিত থাকলে তার অনুমতি নিয়ে ইতিকাফে বসুন। ইতিকাফের জন্য বাড়িতে নামাযের নির্ধারিত জায়গায় বসতে পারেন। নামাযের জন্য নির্ধারিত কোনো জায়গা না থাকলে কোনো জায়গা নির্দিষ্ট করে ইতিকাফের জন্য বসতে পারেন। এভাবে মাবোনরা ইতিকাফ ও কদরের ফযীলত লাভ করতে পারেন।

আট. ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার চর্চা করা

রমযান মাস সৌহার্দ সম্প্রীতির মাস। ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তা রক্ষার মাস। এ সময়ে উচিত মানুষ মানুষের জন্য এগিয়ে আসা। অপর ভাইয়ের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। রমযানের পর ঈদের পূর্বে ছদাকাতুল ফিতর আদায়ের বিধান রয়েছে। যাতে গরীবের ঘরেও ঈদের আনন্দ বিরাজ করে। অনেকে রমযানে অধিক ফযীলত প্রাপ্তির আশায় যাকাত প্রদান করে থাকেন। বিত্তশালীদের উচিত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাকাতের হিসাব করে তা উপযুক্ত পাত্র পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। তেমনি কেবল যাকাত ছদাকাতেই ক্ষান্ত না থেকে উচিত সাধারণ দানেরও অভ্যাস গড়ে তোলা। এ ধরনের দানের বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। তবে সবক্ষেত্রে মনে রাখবআমাকে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের খেদমত করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমার উপর এটা আমার রবের অনুগ্রহ। আমি তাঁর বান্দাদের সহযোগিতা করে তাদের উপর খুব অনুগ্রহ করে ফেলছিতা নয়। এহসান করছি মানসিকতা নয়মাখলুকের খেদমত করার সুযোগ পাচ্ছি এজন্য কৃতজ্ঞতাবোধ নিজের মধ্যে জাগরূক রাখব। এভাবে রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাব থেকেও মুক্ত থাকা যাবে– ইনশাআল্লাহ।

পবিত্র রমযানুল মুবারক। হিংসাবিবাদকোন্দলদলাদলি সকল প্রকার অনাচার পাপাচার ভুলে যাবে। গালিগালাজগীবতশেকায়েতচোগলখুরি ইত্যাদি মন্দ স্বভাবগুলোর লাগাম টেনে ধরবে। এভাবে সকল মানবিকতার উন্নয়ন ও পাশবিকতার অপনোদনের মাধ্যমে মাসব্যাপী তাকওয়ার চর্চা অব্যাহত রাখলে মুমিনের ঈমানী যিন্দেগী সতেজতা লাভ করবে– ইনশাআল্লাহ।

নয়. সময়ের হেফাযতের প্রতি যত্নবান হওয়া

রমযান মাস অত্যন্ত মূল্যবান একটি মাস। এই মাসে এমন একটি রাত আছেযা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অন্তত একটি রাতের বিবেচনা করলেও বুঝে আসেএ মাসের গুরুত্ব কত। কাজেই এই সময়গুলো যথাযথ কাজে লাগানোর প্রতি অত্যন্ত সজাগ থাকা জরুরি। আমার সময়গুলো কীভাবে বেশি থেকে বেশি আমলের হালতে কাটে। শুধু তাই নয়সচেতন মুমিন এভাবেও চিন্তা করেআমার সময়গুলো কেবল ফলপ্রসূ নয়কীভাবে অধিক থেকে অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে। এভাবে তারা জীবনের রুটিন ঢেলে সাজান। এজন্য সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছেদ্বীনী বিবেচনায় যেসকল বিষয় লাগবিয়াত’ তথা অর্থহীন সেগুলো পরিহার করতে হবে। আর যেগুলো নির্দ্বিধ গুনাহ সেগুলো থেকে যোজন যোজন দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। মূলত অর্থহীন বিষয় থেকে বেঁচে থাকাটা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য অনেক বড় সহায়ক।

দশ. রমযানে উমরা আদায়

আল্লাহর ঘর যিয়ারত করা এবং বারবার যিয়ারত করা! এ তো মুমিনের পরম আকাক্সক্ষার বিষয়। কিন্তু সবসময় তো আর হজ্ব করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। বছরে একবারই হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়। আর প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে হজ্বে যাওয়াটাও মুশকিল ব্যাপার। কিন্তু উমরার সময় থাকে বছরব্যাপী। তাই আল্লাহর ঘরের প্রেমিকরা বছরের বিভিন্ন সময় ছুটে যান হেজাযপানেকালো ঘরের ছায়া পেতে এবং সবুজ গম্বুজের পরশ নিতে! তবে সময় সুযোগ এবং সামর্থ্য থাকলে রমযানে আল্লাহর ঘরের হাযিরী মুমিনের ঈমান ও রূহানিয়াতের তারাক্কীর ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। এছাড়া রমযানে উমরা আদায়ে রয়েছে বিশেষ ফযীলতও। হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

عُمْرَةٌ فِي رَمَضَانَ تَعْدِلُ حَجّةً.

রমযান মাসের উমরা হজ্বের সমতুল্য। মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৪৭৯৫

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই তাওফীক নসীব করুন এবং বারবার দান করুন এ সৌভাগ্য! আমীন!

এখানে সংক্ষেপে দশটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল। মাহে রমযানুল মুবারকে এ আমলগুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নশীল হব। এছাড়া সকল আমালে খাইরিয়্যাহ’ তথা যেকোনো ধরনের নেক ও কল্যাণের পথে ধাবিত হব এ মাসে। মুহূর্তে মুহূর্তে স্মরণ রাখবএ মাস তাকওয়া হাছিলের মাসযা মুমিনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। এমন কাজ করার চেষ্টা করিযা আমার তাকওয়াকে মজবুত ও সুদৃঢ় করে। ওইসব বিষয় থেকে সম্পূর্ণ বেঁচে থাকিযা তাকওয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবেই আমার রমযান হবে ফলপ্রসূইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।

Share:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *